খোরশেদ আলম জীবন
ময়মনসিংহের আনন্দমোহন কলেজ থেকে পড়াশুনা শেষ করে ১৯৮৮ সালে পাপুয়া নিউগিনি’তে পাড়ি জমান আব্দুল ওয়াহেদ। সেখানে প্রথমে শিক্ষকতা পেশায় নিয়োজিত হলেও পরবর্তীতে শিক্ষকতা ছেড়ে ব্যবসা শুরু করেন তিনি। আব্দুল ওয়াহেদ বর্তমানে পাপুয়া নিউগিনি’র র্শীষস্থানীয় ব্যবসা প্রতিষ্ঠান Desh Besh Enterprises Ltd. এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক। এই ব্যবসা প্রতিষ্ঠানটি পাপুয়া নিউগিনি’তে সুপার মার্কেট, সুপারশপ চেইন, ফাস্ট ফুড এন্ড বেকারী, রেষ্টুরেন্ট চেইন, ফিলিং স্টেশন, ট্রান্সপোর্ট এন্ড লজিস্টিকস, কন্টেইনার ইয়ার্ড, এপার্টমেন্ট ইত্যাদি ব্যবসায় জড়িত।
২০০৭ সালে পাপুয়া নিউগিনি’র Bank South Pacific Ltd. এ ব্যক্তিগত একাউন্ট খুলে VISA International Debit Card গ্রহণ করেন আব্দুল ওয়াহেদ। ২০১৪ সালের অক্টোবর মাসের শেষ দিকে ব্যবসায়িক কাজে সিঙ্গাপুরে আসেন আব্দুল ওয়াহেদ। কাজ শেষে ফিরবেন বাংলাদেশে।
ব্যবসায়িক কাজ শেষে সিঙ্গাপুরের PARKROYAL হোটেলের বিল পরিশোধ করতে হোটেলের POS Machine এ নিজের VISA International Debit Card প্রবেশ করাতেই মেশিনের স্ক্রিনে ভেসে উঠে- ‘Your Card has been restricted. Please contact to your bank’. কয়েকবার চেষ্টা করে ব্যর্থ হন আব্দুল ওয়াহেদ।
নিজের কাছে থাকা নগদ টাকা ও পরিচিতজনদের সহায়তায় পাপুয়া নিউগিনি’তে ফিরে যান তিনি। যোগাযোগ করেন Bank South Pacific Ltd. কর্তৃপক্ষের সাথে। ব্যাংক কর্তৃপক্ষ জানায় Fraudulent Foreign Transaction (প্রতারণা মূলক বৈদেশিক লেনদেন) সন্দেহে তার ভিসা কার্ডটি Restricted করা হয়েছে।
তবে ব্যাংক কর্তৃপক্ষ এই লেনদেনের দায় আব্দুল ওয়াহেদের উপর চাপিয়ে জানায় আব্দুল ওয়াহেদ তার কোন আত্মীয়/কর্মচারীকে কার্ডের তথ্য সরবরাহ করেছে, যে তথ্য ব্যবহার করে সেই আত্মীয়/কর্মচারী ২০১৪ সালের ২১.০৭.২০১৪ ইং তারিখ থেকে ১৭.১০.২০১৪ ইং পর্যন্ত আব্দুল ওয়াহেদের ভিসা কার্ড ব্যবহার করে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, অষ্ট্রেলিয়া, জার্মানি, নেদারল্যান্ডস, হংকং, চীন, থাইল্যান্ড ও বাংলাদেশে অনলাইনে কেনাকাটা ও ভার্চুয়াল কার্ড ক্রয় করে প্রায় সাড়ে তিন কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে।
ব্যাংকের এ দায়সারা বিবৃতি প্রত্যাখান করেন আব্দুল ওয়াহেদ। ক্ষতিপূরণ দাবি করে পাপুয়া নিউগিনি’র ন্যাশনাল কোর্টে Bank South Pacific Ltd. এর বিরুদ্ধে মামলা করেন তিনি। Bank South Pacific Ltd. তার বিরুদ্ধে পাল্টা অভিযোগ করে আত্মীয়/কর্মচারীকে কার্ডের তথ্য পাচার করে আব্দুল ওয়াহেদ নিজেই দাবিকৃত টাকা খরচ করিয়ে ক্ষতিপূরণ দাবির পাশাপাশি ব্যাংকের সুনাম নষ্ট করেছেন।
ক্ষতিপূরণ আদায়ের পাশাপাশি ব্যাংকের অভিযোগ মিথ্যা প্রমাণে আইনি লড়াই শুরু করে আব্দুল ওয়াহেদ। আইনজীবি Peter Beswick এর মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, অষ্ট্রেলিয়া, জার্মানি, নেদারল্যান্ডস, হংকং, চীন ও থাইল্যান্ডে তার কার্ড থেকে এই Fraudulent Foreign Transaction (প্রতারণা মূলক বৈদেশিক লেনদেন) বিষয়ে আইনগত সহায়তা প্রার্থনা করেন তিনি। দেশগুলোর সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ ও শীর্ষস্থানীয় আইনজীবিদের সাথে সশরীরে যোগাযোগও করেন তিনি।
ব্যর্থ হন আব্দুল ওয়াহেদ।
ক্ষতিপূরণ আদায়ের পাশাপাশি ব্যাংকের অভিযোগ মিথ্যা প্রমাণে দেশে দেশে ঘুরতে ঘুরতে বিপর্যস্ত আব্দুল ওয়াহেদ ২০১৯ সালে ডিসেম্বরে বাংলাদেশে এসে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল থানায় মামলা করেন। মামলা নং ১৭, তারিখঃ ১০.১০.২০১৯, ধারাঃ ২২/২৩/২৪/৩০/৩৫ ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, ২০১৮।
তেজগাঁও বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ বিপিএম (বার), পিপিএম (বার) মহোদয়ের সার্বিক তত্ত্ব মানে কি তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল জোনের এডিসি হাফিজ আল ফারুকের নেতৃত্বে এসি আশিক হাসান, তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল ইন্সপেক্টর ইফতেখার হোসেন, এসআই রুহুল আমিন ও এসআই সাইমুম আহমেদের একটি টীম ২৫.০৮.২০২০ তারিখ দিবাগত রাত ১২.৪০ ঘটিকায় মিরপুর ডিওএইচএস এলাকা থেকে নাজমুস সাকেব নাঈম ও তার সহযোগী মইনুল ইসলাম মামুনকে গ্রেফতার করে।
ভিসা কার্ডটি হ্যাক করে কার্ডের গোপন তথ্য চুরির মাধ্যমে হ্যাককৃত ভিসা কার্ডটি থেকে ২১.০৭.২০১৪ ইং তারিখ Theloadnet.com এ ১৪.৯৫ মার্কিন ডলার বিল পরিশোধের মাধ্যমে শুরু করে সর্বশেষ ১৭.১০.২০১৪ ইং পর্যন্ত নিজের Entropay একাউন্টে ভার্চুয়াল ভিসা কার্ড জেনারেট করে ২০৯৯ মার্কিন ডলার ট্রান্সফার করে প্রায় সাড়ে তিন কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার কথা স্বীকার করে নাজমুস সাকেব নাঈম।
হ্যাককৃত ভিসা কার্ডটি ব্যবহার করে প্রথমদিকে দেশীয় কিছু Online Payment Gateway প্ল্যাটফর্মে ১৬টি দামি মোবাইল কিনে আত্নীয়-স্বজন ও পরিচিত জনদেরকে উপহার দেয় সাকেব।
১৫.০৯.২০১৪ তারিখ থাই এয়ারওয়েজে স্ত্রী, পুত্র, কন্যা, শ্যালিকা ও শ্বাশুড়িকে নিয়ে থাইল্যান্ডে যায় সাকেব।
সাকেব তার Entropay একাউন্টে ভার্চুয়াল ভিসা কার্ড জেনারেট করে হ্যাককৃত ভিসা কার্ড থেকে ব্যালেন্স ট্রান্সফার করে। সেই ভার্চুয়াল কার্ড ব্যবহার করে অনলাইনে থাই এয়ারওয়েজের টিকিট কিনে পরিবারের সদস্যদের নিয়ে ১৫.০৯.২০১৪ তে ব্যাংকক যায় সাকেব। তার পরিবারের সদস্যরা বিলাসবহুল হোটেলের অবস্থানের পাশাপাশি শপিং ও ঘোরাঘুরিতে ব্যস্ত থাকলেও হোটেল রুম থেকে বের হয় নি সাকেব। হ্যাককৃত কার্ড ব্যবহার করে অনলাইন শপিংয়ে ব্যস্ত সময় কাটে তার। অনলাইনে একদিনে ১০০টির বেশি লেনদেনও করেছে সে।
নিজেকে ধরাছোয়ার বাইরে রাখতে ০২.০৯.২০১৪ তে অনলাইনে থাই এয়ারওয়েজে ব্যাংকক এবং ০১.১১.২০১৪ তে এমিরেটস এয়ারলাইন্সে ঢাকা থেকে দুবাই হয়ে ব্যাংককে যাওয়ার জন্য বিজনেস ক্লাস ক্লাসে পরিবারের সদস্যদের টিকি কনফার্ম করলেও ভ্রমন করে নি সাকেব বা তার পরিবারের কেউ।
২৪.০৭.২০১৪ থেকে ১৭.১০.২০১৪ পর্যন্ত ৮০ দিনে বাংলাদেশ ও থাইল্যান্ডে অবস্থান করে সাকেব তার Entropay একাউন্ট ব্যবহার করে দুটি ভার্চুয়াল ভিসা কার্ড (Bank of Valletta, Malta) জেনারেট করে হ্যাককৃত ভিসা কার্ড থেকে বিল পরিশোধের মাধ্যমে ৬৯ বারে ৯৮৪৫৯.৩৬ মার্কিন ডলার এবং ২৮.০৭.২০১৪ থেকে ১১.০৮.২০১৪ পর্যন্ত Netelleruk একাউন্ট ব্যবহার করে ভার্চুয়াল ভিসা কার্ড জেনারেট করে ৭ বারে ৯৮১.২৮ মার্কিন ডলার হাতিয়ে নেয়।
২০.০৮.২০১৪ থেকে ১৫.০১.২০১৫ পর্যন্ত ৮টি চেকআউটের মাধ্যমে ৩৪,৯৩,১২০ টাকা সাকেবের একাউন্টে ট্রান্সফার করা হয়।
বাংলাদেশ ও থাইল্যান্ডে অবস্থান করে হ্যাককৃত ভিসা কার্ড ব্যবহার করে অনলাইনে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, অষ্ট্রেলিয়া, জার্মানি, নেদারল্যান্ডস, হংকং, চীন ও থাইল্যান্ডে বিভিন্ন দামি সফটওয়্যার, অ্যাপলের ম্যাকবুক, আইফোন, রোলেক্স ঘড়ি, Clive Christian ব্রান্ডের পারফিউম, ক্যামেরা, ওয়ালেট, কসমেটিকস কিনে সাকেব।
তেজগাঁও বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ বিপিএম (বার), পিপিএম (বার) জানান, আইটি বিশেষজ্ঞ সাকেব হ্যাককৃত ভিসা কার্ড ব্যবহার করে থাইল্যান্ড ও বাংলাদেশে বসে অনলাইনে ১৪৭২ টি ট্রানজেকশনের মাধ্যমে বিশ্বের ৯ টি দেশে শপিং করে সাড়ে তিন কোটি টাকা আত্নসাৎ করে। তথ্য-প্রযুক্তির সহায়তায় এই হ্যাকারকে আইডেনটিফাই করে গ্রেফতার করি। তার কাছ থেকে জব্দকৃত ল্যাপট ও তার ৩ টি ইমেইলে এই জালিয়াতির প্রমাণ পাওয়া গেছে।
তিনি আরো বলেন, সাকেব খারাপ কাজে তার মেধা ব্যবহার করেছে। বাংলাদেশ ছাড়াও বিশ্বের অন্যান্য দেশে গিয়েও সে এই কার্ডে ট্র্যানজেকশন করেছে, যাতে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী তাকে সনাক্ত করতে না পারে। এটা পাপুয়া নিউ গিনি’র ঘটনা। আন্তর্জাতিক বিষয়। ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তি বিশ্বের বাঘা বাঘা দেশের আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে অভিযোগ করলেও, তারা পারে নি। আমরাই এই হ্যাকারকে গ্রেফতার করে মামলার মূল রহস্য উদঘাটন করেছি।
নাজমুস সাকেব নাঈমের জন্ম ১৯৮৫ সালে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের The International University থেকে Computer Science এ স্নাতক সাকেব পরবর্তীতে Online Payment System, Artificial Intelligence, Machine Learning, Digital Distribution, Anti-Fraud Suite, Cloud and Distributed Computing, Deep Learning Natural Language Processing বিষয়ে পড়াশুনা করেছেন।
সাকেবের তৈরী করা Pekhom (A complete reservation systam with online hotel booking) অনলাইনে হোটেল বুকিংয়ের জন্য bKash, Sheba.xyz, One Bank, Jamuna Bank, Circle Fintech এর সাথে চুক্তিবদ্ধ বাংলাদেশের ৩৫০টির অধিক হোটেলের রুম ইনভেন্টরি booking.com, Expedia তে অটো আপডেট করেছেন তিনি।
EasyPayWay (Payment Gateway Service Provider) প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি Blockbuster Cinemas ও Silver Screen Cineplex এর ডিজিটাল টিকিট ব্যবস্থার রুপকার সাকেব।
থাইল্যান্ডের Siam University তে গেস্ট লেকচারার হিসেবে কাজ করার পাশাপাশি Civil Bank Nepal এ Deep Learning Natural Language Processing কনসালটেন্ট হিসেবে কাজ করেছেন তিনি।
ফেসবুক-কমার্স বা এফ-কমার্সের জন্য গ্রাহক সেবা সমাধান অর্থাৎ ফেসবুকের মাধ্যমে পণ্য কিনতে গ্রাহককে পুরো প্রক্রিয়ায় সহায়তার জন্য সাকেব উদ্ভাবিত চ্যাট বট ‘দ্য জেড বয়’ (www.thezboy.com) নিয়ে মার্কিন সাময়িকী অনট্রাপ্রেনার ও ফোর্বসে ২০১৭ সালে সাকেবের সাক্ষাৎকার প্রকাশিত হয়।
সাকেব Nandan Group (Head of IT), The Codero Limited (CEO), SSL Wireless (Head of E-commerce), ZARSS Solutions Limited (CEO) হিসেবে কাজ করেছেন।