নিউজ ডেক্সঃ
দেশের ৯ জেলার ১৬টি পয়েন্ট সাংবাদিকদের জন্য ‘ভয়ঙ্কর’ হয়ে উঠেছে। এসব স্থানে দফায় দফায় সাংবাদিক নীপিড়ন, নির্যাতন, মামলা হয়রানি এমনকি হত্যাকান্ডও ঘটেছে। বিপজ্জনক স্থানসমূহে ক্ষমতাসীন দলের নেতা, জনপ্রতিনিধি, চিহ্নিত অপরাধী, প্রশাসনিক কর্মকর্তা এমনকি বিরোধী দলের নেতা কর্মিরাও সাংবাদিকদের উপর হামলা চালাতে দ্বিধা করছেন না। খোঁজ নিয়ে দেখা যায়, দলীয় চরম কোন্দলে জর্জরিত নেতারা সাংবাদিকদেরও পক্ষে বিপক্ষে ঠেলে দেন এবং পরস্পর আক্রমণের লক্ষ্যবস্তুতে পরিনত করেন। সারাদেশেই কমবেশি সাংবাদিক নির্যাতন ও হয়রানির ঘটনা ঘটলেও সাংবাদিকদের জন্য সবচেয়ে হুমকিপূর্ণ এলাকাগুলো হচ্ছে, পাবনা, জামালপুর, কুষ্টিয়া, কক্সবাজার, নোয়াখালী, ঢাকার সাভার ও ধামরাই, গাজীপুর সদর ও টঙ্গী, নারায়নগঞ্জের সদর, সোনারগাঁও ও রুপগঞ্জ, ঝালকাঠি জেলার সদর ও রাজাপুর। এছাড়া খোদ রাজধানীতেও উত্তরা, মিরপুর, যাত্রাবাড়ী এলাকা ‘বিপজ্জনক’ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। গত পাঁচ বছরে সাংবাদিক নির্যাতনের ঘটনাবলী পর্যবেক্ষণসহ এ প্রতিবেদকের নিজস্ব অনুসন্ধানে এসব তথ্য বেরিয়ে এসেছে।
সাংবাদিক নির্যাতনের অভয়াশ্রম খ্যাত এ জনপদগুলোতে মুক্তবুদ্ধির চর্চার কোন অস্তিত্ব নেই বললেই চলে। সেখানে আছে সামাজিক বিদ্বেষ, হানাহানি, রাজনৈতিক প্রতিহিংসা আর দখলবাজ-লুটেরা শ্রেণীর একচ্ছত্র আধিপত্য। পেশাদার অপরাধীরাই দন্ডমুন্ডের কর্তা হওয়ায় সর্বত্র অসম পরিস্থিতি বিরাজমান রয়েছে। এ পরিবেশে সকল শ্রেণী পেশার মানুষজন জিম্মিদশায় থাকলেও মাঝে মধ্যে সংবাদকর্মিরা প্রতিবাদী হওয়ার চেষ্টা করে, ঠিক তখনই তাদের উপর নেমে আসে নানা নির্মমতার খড়গ। তবে ভুক্তভোগী সাংবাদিকরা জানিয়েছেন, সাংবাদিক নির্যাতনের প্রতিটি ঘটনার পেছনেই প্রতিদ্বন্দ্বী সাংবাদিক গ্রুপের নেপথ্য ইন্ধন থাকে। এক্ষেত্রে চিহ্নিত অপরাধী ও দলীয় নেতা কর্মিদের সাংবাদিকতায় অনুপ্রবেশ, অশিক্ষিত শ্রেণীর অপেশাদারিত্ব, অপসাংবাদিকতা, ভূঁইফোড় নানা সংগঠন গড়ে ওঠা, সংবাদের পরিবর্তে টুপাইস কামানোর ধান্ধাবাজিতে বেশি উৎসাহ থাকার কারণেও সাংবাদিকরা হুমকি ও হামলার শিকার হচ্ছেন বলে জানা গেছে।
এক বছরেই নির্যাতিত ২৪৭ সাংবাদিক
২০২০ সালে সংবাদ সংগ্রহ ও প্রকাশকালে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, সরকারি কর্মকর্তা, সন্ত্রাসী ও রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের নির্যাতনের শিকার হয়েছেন ২৪৭ জন সাংবাদিক। আর এতে প্রাণ হারিয়েছেন দুজন। মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) এর দেওয়া প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, ‘করোনাকালেও মত প্রকাশের অধিকার খর্ব করে দমন-পীড়ন বেড়েছে। বিশেষ ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা ও গ্রেফতার বৃদ্ধি পেয়েছে। আসকের তথ্য সংরক্ষণ ইউনিটের তথ্য মতে ২০২০ সালে ১২৯টি ডিজিটাল মামলায় ২৬৮ জনকে আসামি করা হয়। এসব মামলায় সিংহভাগ ক্ষেত্রেই সাংবাদিকদের আসামি করা হয়।
দেশে সাংবাদিক নির্যাতনের ঘটনা ঘটছে হরহামেশাই। পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে সাংবাদিকদের গুম, খুন ও নির্যাতনের শিকার হতে হচ্ছে। কখনো সন্ত্রাসী গোষ্ঠী, স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠী, কখনোবা প্রশাসন এসবের পেছনে থাকে। কিন্তু এগুলোর বিচার না হওয়ায় দেশে এমন নিপীড়নের ঘটনা ঘটেই চলেছে। এরমধ্যে কক্সবাজারের সাংবাদিক ফরিদুল মোস্তফা, ময়মনসিংহ প্রতিদিন পত্রিকার সম্পাদক খায়রুল আলম রফিক, সুনামগঞ্জের তাহিরপুরে সংবাদ এর সাংবাদিক কামাল হোসেনকে গাছে বেধে নির্মম নির্যাতন, বাংলা ট্রিবিউনের কুড়িগ্রাম প্রতিনিধি আরিফুল ইসলাম রিগ্যানকে রাতের আঁধারে তুলে নিয়ে বিবস্ত্র করে নির্যাতন চালানোর পর মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে কারাদন্ড প্রদান, পক্ষকাল পত্রিকার সম্পাদক শফিকুল ইসলাম কাজলকে রাতের আধারে তুলে নিয়ে চোখ মুখ বেধে ৫৩ দিন অজ্ঞাত স্থানে আটক রাখা, জামালপুরের সাংবাদিক শেলু আকন্দ’র হাত পা গুড়িয়ে চিরতরে পঙ্গু বানানোর ঘটনা দেশবাসীর হৃদয়ে গভীরভাবে নাড়া দিয়েছে। এসব নিয়ে সাময়িক হৈচৈ হয়, প্রতিবাদ মিছিল, মানববন্ধন, কলম বিরতিসহ নানা আন্দোলনও হয় কিন্তু পরিস্থিতি পাল্টায় না মোটেও। সাংবাদিক ফরিদুল মোস্তফার নামে মিথ্যা মামলার হয়রানি নিয়ে সাংবাদিক নেতা থেকে শুরু করে এমপি, মন্ত্রী পর্যন্ত সকলেই আফসোস করেন কিন্তু তার মামলাগুলো দ্রুত নিস্পত্তির ব্যবস্থা করে তাকে বেঁচে থাকার উপায় করে দিতে কেউ এগিয়ে আসেন না।
তাছাড়া ২০১৮ সালের ২৮ আগস্ট পাবনায় আনন্দ টিভি’র সাংবাদিক সুবর্ণা নদী, ২০১৯ সালের ২১ মে প্রিয় ডট কমের সাংবাদিক ইহসান ইবনে রেজা ফাগুন, ২০২০ সালেল ১১ অক্টোবর নারায়ণগঞ্জের বন্দর উপজেলায় ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে সাংবাদিক ইলিয়াস শেখ (৪৫) কে এবং সর্বশেষ গত ২০ ফেব্রুয়ারি নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জে সাংবাদিক বোরহানকে নির্বিচারে গুলি চালিয়ে হত্যার ঘটনায় সর্বত্র তোলপাড় সৃষ্টি হয়। তবে চলতি বছরের শুরু থেকেই সাংবাদিক নীপিড়ন নির্যাতনের ঘটনা অসাভাবিক ভাবে বৃদ্ধি পাওয়ার অভিযোগ উঠেছে।
সাংবাদিক নেতারা বললেন…
সাংবাদিক নির্যাতনের প্রতিবাদ জানাতে জানাতেই সাংবাদিক নেতা আহমেদ আবু জাফরের নাম বদলে গেছে, তিনি এখন সর্বত্র পরিচিতি পান ‘প্রতিবাদী জাফর’ নামে। বাংলাদেশ মফস্বল সাংবাদিক ফোরামের (বিএমএসএফ) মহাসচিব আহমেদ আবু জাফর বলেন, চলতি বছরের শুরু থেকে প্রায় প্রতিদিনই কোথাও না কোথাও সাংবাদিক নির্যাতন, হুমকি, মামলা হয়রানির শিকার হচ্ছেন। বহুমুখী ঝুঁকির মধ্যেই দায়িত্ব পালনে বাধ্য হচ্ছেন সাংবাদিকরা। বিএমএসএফ মহাসচিব বলেন, পেশার এই ঝুঁকি রাজধানী ঢাকায় অপেক্ষাকৃত কম হলেও ঢাকার বাইরে তা বহুগুণ বেশি।
হত্যা, হত্যার হুমকি, মানসিক চাপ, শারীরিক আঘাত, হামলা ও মামলার ঘটনা বেড়েই চলেছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, স্থানীয় পর্যায়ের কোথাও কোথাও অপরাধীদের একচ্ছত্র আধিপত্য থাকার কারণেই সাংবাদিকরা হুমকি ও বিপন্নতার মুখে পড়ছেন। সরকার ও প্রশাসনের নানা অনিয়ম, দুর্নীতি ও স্বেচ্ছাচারিতা নিয়ে লিখলেও নেমে আসছে নির্যাতন নির্মমতার খড়গ। আহমেদ আবু জাফর বলেন, ‘অপরাধ, দুর্নীতি, জবর দখলের প্রতিবেদন প্রকাশ করার অপরাধে অনেক সাংবাদিককে এলাকাছাড়া হতে হয়েছে। অবস্থা এতই শোচনীয় পর্যায়ে।
প্রতিবেদকঃ
সাইদুর রহমান রিমন