নিউজ ডেক্সঃ
লায়লাতু নিসফিম মিন শাবান বা শাবান মাসের ১৪ তারিখ দিবাগত রাত এক বরকতময় রজনী। যা আমাদের ভারতীয় উপমহাদেশে ‘শবে বরাত’ নামে পরিচিত। শবে বরাত কথাটি ফারসি থেকে এসেছে। শব মানে রাত, বরাত মানে মুক্তি; শবে বরাত অর্থ মুক্তির যামিনী। ‘শবে বরাত’-এর আরবি হলো ‘লাইলাতুল বারায়াত’। হাদিস শরিফে যাকে ‘নিসফ শাবান’ বা শাবান মাসের মধ্য দিবসের রজনী বলা হয়েছে।
হাদীসে এই রাতের ফযিলতের কথা এসেছে। তবে দু:খজনক হলে সত্য যে, বর্তমান কিছু সংখ্যক ব্যক্তি এই রাতের ফযিলতকে অস্বীকার করছে। আবার আরেক শ্রেণীর লোক এই রাতে বিশেষ ইবাদতের আনুষ্ঠানিকতার মাধ্যমে বিদয়াত করে যাচ্ছে।
এই রাতের ফযিলত হাদীস দ্বারা প্রমাণিত:
আয়িশা সিদ্দিকা (রা.) বলেন, একবার রাসুলুল্লাহ (সা.) নামাজে দাঁড়ালেন এবং এত দীর্ঘ সেজদা করলেন যে আমার ধারণা হলো, তিনি মৃত্যুবরণ করেছেন; আমি তখন উঠে তাঁর পায়ের বৃদ্ধাঙ্গুলি নাড়া দিলাম, তাঁর বৃদ্ধাঙ্গুলি নড়ল; তিনি সেজদা থেকে উঠলেন এবং নামাজ শেষ করে আমাকে লক্ষ করে বললেন, হে আয়িশা! তোমার কি এ আশঙ্কা হয়েছে? আমি উত্তরে বললাম, ইয়া রাসুলুল্লাহ (সা.)! আপনার দীর্ঘ সেজদা থেকে আমার আশঙ্কা হয়েছিল আপনি মৃত্যুবরণ করেছেন কি না? নবীজি (সা.) বললেন, তুমি কি জানো এটা কোন রাত? আমি বললাম, আল্লাহ ও আল্লাহর রাসুলই ভালো জানেন। তখন নবীজি (সা.) বললেন, এটা হলো অর্ধশাবানের রাত; এ রাতে আল্লাহ তাআলা তাঁর বান্দাদের প্রতি মনোযোগ দেন; ক্ষমাপ্রার্থনাকারীদের ক্ষমা করে দেন, অনুগ্রহ প্রার্থীদের অনুগ্রহ করেন। আর বিদ্বেষ পোষণকারীদের তাদের অবস্থাতেই ছেড়ে দেন। (শুআবুল ইমান, ৩/৩৮২)
আয়িশা (রা.) থেকে আরো বর্ণিত, নবীজি (সা.) এ রাতে মদিনার কবরস্থান ‘জান্নাতুল বাকি’তে এসে মৃতদের জন্য দোয়া ও ইস্তিগফার করতেন। তিনি আরও বলেন, নবীজি (সা.) তাঁকে বলেছেন, এ রাতে বনি কালবের ভেড়া বকরির পশমের (সংখ্যার পরিমাণের) চেয়েও বেশিসংখ্যক গুণাহগারকে আল্লাহ ক্ষমা করে দেন।
(তিরমিজি, হা: ৭৩৯)
এই রাতের মর্যাদা সম্পর্কে ইসলামিক স্কলারদের বক্তব্য:
(ক) ইমাম ইবনে তাইমিয়া রহ. লিখেন:
‘শবে বরাতের ফজিলত রয়েছে। কতেক সালফে সালেহীন এ রাতে নফল নামায পড়তেন।’
(মাজমুউল ফাতাওয়া ৫/৩৪২)
ইমাম ইবনে তাইমিয়া রহ. আরো বলেন
এই রাতের ফজিলতে কয়েকটি হাদিস ও আছর বর্ণিত হয়েছে যেগুলো এ কথা প্রমাণ করে যে এটি নিশ্চয় একটি মহিমান্বিত রাত এবং এ রাতে সালাফের এক অংশ বেশি বেশি নামায পড়তেন।
(ইক্বতিযাউস সিরাতিল মুসতাক্বিম’ ১/৩০১)
(খ) ইমাম ইবনুল হাজ্জ্ব রহ. লিখেন:
“মোটকথা হচ্ছে, এ রাতের অনেক মাহাত্ম্য ও বিশাল কল্যাণ রয়েছে। সালফে সালেহীন এ রাতকে মর্যাদার দৃষ্টিতে দেখতেন এবং আগমনের পূর্বে তাতে নফল ইবাদতের জন্য প্রস্তুতি নিতেন।’
(আলমাদখাল ১/২৯৯)
(গ) ইমাম বায়হাকী, হাফেজ মুনযিরী, হাফিজ ইবনে হাজার আসকালানী, ইমাম ইবনে তাইমিয়া, ইমাম ইবনুল কাইয়্যিম, ইমাম ইবনে রজব, হাফিজ জুরকানী, আল্লামা আব্দুর রহমান মুবারকপুরী প্রমুখ ইসলামিক স্কলারগণ শবে বরাতের হাদিসকে হাসান বলেছেন।
(শুআবুল ঈমান ৩/৩৮২, আততারগিব ওয়াত তারহিব ২/১৪৫, আমালিয়ুল মুতলাকা পৃ.৮৯,শরহুল মাওয়াহিব ১০/ ৫৬১, তুহফাতুলআহওয়াজি ৩/ ১৬১)
(ঘ) শাইখ নাসিরুদ্দিন আলবানী রহ. তো শবে বরাতের ফজিলতের হাদিসকে সহিহই বলে ফেলেছেন। (সিলসিলাতুছ ছহিহাহ ৩/১৩৫)
শাইখ নাসিরুদ্দীন আলবানী রহ. বলেন:
সারকথা হলো, শবে বরাত সংক্রান্ত হাদিস তার সকল সূত্র মিলিয়ে নিঃসন্দেহে সহিহ। অতএব হাদিসের সনদ বিশ্লেষক বিদ্বানগণের রেফারেন্সে শাইখ জামালুদ্দীন কাসেমী রহ. তাঁর ‘ইসলাহুল মাসাজিদ’ বইয়ে যে কথা উদ্ধৃত করেছেন যে, শবে বরাতের মাহাত্ম্যের ব্যাপারে কোন সহিহ হাদিস নেই এ দাবী মেনে নেওয়া যথাযথ নয়। আর তাঁদের কেউ যদি এমন উক্তি সাধারণ ও ব্যাপকহারে করে থাকে, তাহলে নিশ্চয় তা তাড়াহুড়াপ্রসূত এবং সবসূত্রকে ভালোভাবে যাচাই বিহীন কথা।
(সিলসিলাতুস সহীহাহ ৩/১৩৫, হা. ১১৪৪)
(ঙ) আল্লামা আব্দুল হাই লাখনৌভি
‘এ রাতে নফল ও বিভিন্ন ইবাদত করে রাত্রিজাগরণ মুস্তাহাব হওয়ার ব্যাপারে কোন কালাম নেই।’
(‘আল আছারুল মারফূআহ ফিল আখবারিল মাওজুআহ’ পৃ.৭০)
(চ) ইবনে রজব হাম্বলী রহ. লিখেন:
‘মুমিন ব্যক্তির উচিৎ হলো এ রাতে একনিষ্ঠ হয়ে যিকির, দুআ ইত্যাদি করা…ইমাম শাফেয়ী রহ. বলেন, আমাদের কাছে এ মর্মে হাদিস পৌঁছেছে যে পাঁচ রাতে দুআ কবুল হয়: জুমুআর রাতে, দুই ঈদের রাতে, রজবের প্রথম রাতে এবং শবে বরাতের রাতে।’
(লাতায়িফুল মা’আরিফ ফী মা লিমাওয়াসীমিল আ’মি মিনাল ওযায়েফ’ পৃ. ১৫১)
এই রাতে যা করা নিন্দনীয় ও বিদ’আত:
তবে ফটকা বাজানো, খিছুরী পাকিয়ে বন্টন, শীর্ণি-সালাদ, হালওয়া, মসজিদে একত্র হয়ে এবাদত যিকির, আতশবাজি, চেরাগপ্রথা ও কবরস্থানে মেলার ন্যায় গমণাগমন, বরাতের নামায বলে জামাতে নামাযের আয়োজন করা ইত্যাদি সুস্পষ্ট বেদাআত ও কুসংস্কার। কেননা এ রাতে নির্দিষ্ট তরিকায় নির্দিষ্ট কোন আমল নেই। বরং যার যেভাবে সুবিধা, যতটুকু সম্ভব, যে কোন এবাদত বা বিভিন্ন ধরণের এবাদত করতে পারবে। কোন বাধ্য-বাধকতা নেই।
মূল লেখকঃ-আল্লামা তাক্বি উসমানী দাঃবাঃ।
ভাষান্তর
মোঃমোস্তাফিজুর রহমান
বি.এস.এস. অনার্স, (অধ্যয়নরত) রাষ্ট্র বিজ্ঞান ,ভাওয়াল বদরে আলম বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ, গাজীপুর।
তাকমিল ফিল হাদিস, দারুল উলুম, মিরপুর ১৩ ঢাকা।
ইসলামী ফতোয়া বিভাগ (ইফতা)
জামিআ মোহাম্মদিয়া নূরুল কুরআন মিরপুর ২ ঢাকা।