মোঃ আব্দুল বাতেন বাচ্চু,,
ওকি গাড়িয়াল ভাই কতো রবো আমি পন্থের দিকে চাইয়া রে?”
গাড়িয়াল পত্নীর বিষণ্ণ এই গান এখন শুধুই স্মৃতি হয়ে রয়েছে গানের সুরে। এখন আর গাড়িয়াল ভাইরা মালামাল নিয়ে দূরদূরান্ত যায় না। আধুনিক সভ্যতা এবং উন্নত প্রযুক্তির গাড়ির কদরের কারণে হারিয়ে যাচ্ছে গাড়িয়াল ভাইদের গরু-মহিষের গাড়ি।
প্রাচীনকাল থেকেই মানুষের চলাচলের অন্যতম মাধ্যম ছিল গরু এবং মহিষের গাড়ির। সকাল বেলা ক্যাচ ক্যাচ শব্দে বাড়ীর পাশ দিয়ে চলতো এই দুই চাকার বাহনটি। এখন নেই আর গরু-মহিষের গাড়ির চাকার ক্যাচ ক্যাচ শব্দ। গরু-মহিষের গলায় ঝোলানো ঘণ্টার টুং টাং আওয়াজ। তবে যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে গিয়ে প্রায় হারিয়ে যাচ্ছে প্রাচীন কৃষকদের এই ঐতিহ্য।
অথচ এক সময় এই গরুর গাড়িকে নিয়ে তৈরি হয়েছে সিনেমা, নাটক এবং গান। তবে কালের পরিক্রমায় সভ্যতার উন্নয়নের ফলে এখন আর খুব একটা চোখে পড়েনা প্রাচীন এই বাহনটি।
এক সময় বিয়ের বর-কনে আনা নেওয়ার অন্যতম মাধ্যম ছিল কাঠের দুই চাকার গরু-মহিষের টানা এই বাহন। তাছাড়া ফসল আনা নেওয়া এবং দূরদূরান্ত চলাচলের অন্যতম মাধ্যম ছিল এটি। তবে বর্তমানে যান্ত্রিক সভ্যতার কারণে এবং সময় বাঁচানোর জন্য এই মাধ্যমটি এখন আর তেমন ব্যবহৃত হচ্ছে না।
যুগের সাথে তাল মিলিয়ে পরিবর্তন এসেছে এই বাহনটিতে। আগে গরু-মহিষের গাড়িতে ব্যবহৃত হতো কাঠের চাকা কিন্তু সভ্যতার সাথে তাল মিলিয়ে এটিতে এখন টায়ার টিউবের চাকা ব্যবহৃত হচ্ছে। এখন আর চোখে পড়ে না এই গাড়ি। গরু-মহিষের গাড়ির কদর আর না থাকায় গাড়িয়ালদের জীবনেও এসেছে পরিবর্তন।
অনেকে জীবিকার তাগিদে পরিবর্তন করেছেন এ পেশা। এদের মধ্যে কেউ শহরে গিয়ে দিন মজুর খাটছেন, আবার কেউবা রিকশার হ্যান্ডেল ধরেছেন, কেউ অন্য কোনো পেশায় নিয়োজিত হয়েছেন।
গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলার মাওনা গ্রামের আবুল হোসেন মৃধা বলেন, বাবার হাত ধরে মহিষের গাড়ি চালানো শিখেছি। নিজেদের জমি-জমার ফসল মাঠ থেকে বাড়িতে নিয়ে আসার জন্য এই মহিষের গাড়ি ব্যবহার করতাম। নদীতে যখন হাঁটু পানি থাকতো তখন মহিষের গাড়ি নদীর ভেতর দিয়েই পার করতাম। এছাড়া একটা গরুর গাড়িও ছিল। সেটা দিয়ে বরযাত্রী, নাইওরি আনা নেয়া এবং কোথাও গেলে নিয়ে যেতাম।
তিনি আরও বলেন, প্রায় ৪০ বছর এই হাতে মহিষের গাড়ি চালিয়েছি। এখন আর সে অবস্থা নেই। এলাকায় মহিষের গাড়িই নেই। তাছাড়া একজোড়া মহিষের দাম পিকআপ এর চাইতেও বেশি তাই আমিও কয়েক বছর আগে গাড়িটি বিক্রি করে দিয়েছি।
উপজেলার কাওরাইদ ইউনিয়নের নয়াপাড়া গ্রামের গাড়োয়ান সিদ্দিক মিয়া বলেন, এখন আর মহিষের গাড়ি চলে না। যন্ত্রের গাড়ির কাছে মহিষের গাড়ির কোনো পাত্তা নেই। তাই মহিষের গাড়ি বিক্রি করে দিয়েছি। এখন কৃষি কাজ করছি। দুইটি মহিষ আছে শুধু হাল চাষ করার জন্য রেখেছি।
শ্রীপুর উপজেলার জাহাঙ্গীরপুর গ্রামের রমিজ মিয়া বলেন, এক সময় মাঠের ফসল কৃষকের বাড়িতে আনার জন্য একমাত্র বাহন ছিল গরু-মহিষের গাড়ি। এখন নিত্য-নতুন কত গাড়ি হয়েছে। ইদানীং তো দেখছি এক মেশিনেই ধান কাটা, মাড়াই হচ্ছে। মহিষের গাড়ি চালিয়ে আর পেট চলে না। তবে বাপ-দাদার পেশা ইচ্ছে করলেও ছাড়তে পারছিনা, কোনো মতে চলে যাচ্ছে দিন। এখন মাঝেমধ্যে বাঁশ আনা নেওয়া এবং ধান আনা নেওয়ার কাজ করি।
শ্রীপুর উপজেলার ডোমবাড়ি চালা গ্রামের হারেছ আলী বলেন পারিবারিক ভাবে আমরা মহিষ পালন করে আসছি। আর সেই সুবাদে আমরা মহিষের গাড়ি দিয়ে বিভিন্ন মালামাল আনা নেওয়া করছি। আগে মহিষের গাড়ির কদর থাকলেও এখন আর তেমন চাহিদা নেই। এখন শুধু ধানের মৌসুমে ধান আনা নেওয়া করা হয় আর বাঁশের খেপ দেওয়া হয়। আগের মতো তো আর আয় রোজগার হয় না।
তিনি আরও বলেন, কোনো মতে পরিবার পরিজন নিয়ে বেচে আছি। মহিষ দুটোর মায়া ছাড়তে পারি না। সবাই মহিষের গাড়ি বাদ দিয়ে দিতে বলে। নিজেরও ইচ্ছা হয় গাড়ি বিক্রি করে দিতে। কিন্তু প্রাচীন এই ঐতিহ্যকে ধরে রাখতে আজো এটাকে ধরে রেখেছি।
শ্রীপুর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান এডভোকেট শামসুল আলম প্রধান বলেন, গরু-মহিষের গাড়ি আমাদের গ্রামীণ ঐতিহ্য। কালের বিবর্তনে এটা প্রায় বিলুপ্তির পথে। ছেলে-মেয়েদের এই গাড়ি সম্পর্কে জানাতে এবং গ্রামীণ বাঙালি ঐতিহ্যকে সবার সামনে তুলে ধরতে বাৎসরিক বিভিন্ন অনুষ্ঠানে গরুর গাড়ি ব্যবহার থাকা উচিত।
শ্রীপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ইউএনও তাসলিমা মোস্তারীর জানান, গ্রাম বাংলার প্রাচীন ঐতিহ্যকে রক্ষা করতে পহেলা বৈশাখের অনুষ্ঠানসহ বিভিন্ন প্রতিযোগিতা ও প্রদর্শনীর সঙ্গে গরু-মহিষের গাড়ির পরিচিতি তুলে ধরা উচিৎ।