অযত্ন-অবহেলায় পড়ে আছে ২০০ বছরের পুরোনো জমিদার বাড়ি
সুনামগঞ্জ থেকে
সুনামগঞ্জে সুরমা নদীর কিছু দূরেই দাঁড়িয়ে রয়েছে ২০০ বছরের পুরোনো এক জমিদার বাড়ি। নাম তার গৌরারং জমিদার বাড়ি। কিন্তু শহরতলির এ বিশাল নিদর্শন সংরক্ষণে কোনো পদক্ষেপ নেই প্রত্নতত্ত্ব অধিদফতরের।
সুরমা নদীর আব্দুজ জহুর সেতু পার হয়ে হাতের বাম দিকে সুনামগঞ্জ-জামালগঞ্জ সড়ক দিয়ে তিন কিলোমিটার গেলেই পাওয়া যায় এ জমিদার বাড়ি।
জানা যায়, ১৮০০ সালের শুরুর দিকে জমিদার রাজেন্দ্রর কুমার চৌধুরী ও রাকেশ রঞ্জন চৌধুরী গৌরারং জমিদারির শাসন করতেন। এরপর তাদের উত্তরাধিকার হিসেবে নগেন্দ্র কুমার চৌধুরীর হাত ধরে জামিদারি বিস্তৃতি লাভ করে। তার ছেলে ছিলেন নিরঞ্জন চৌধুরী। কয়েক বছর আগে তিনিও মারা যান। নিরঞ্জনের ছেলে হলেন অঞ্জন চৌধুরী। তিনি বর্তমানে সুনামগঞ্জ পৌরসভায় কর্মরত রয়েছেন।
গৌরারং জমিদার বাড়ি ১৯৮১-৮২ সালে বন্দোবস্ত নিয়েছিলেন স্থানীয় নৃপেন্দ্র চক্রবর্তী।
তার ছেলে বিজিত চক্রবর্তী বললেন, আমরা ১৯৮১-৮২ সাল থেকে এ বাড়ির খাজনা দিয়ে আসছি। ২০১৯ সালে আমাদের জানানো হয়, এ বাড়ি সরকারিভাবে সংরক্ষণ করা হবে। প্রত্নতত্ত্ব অধিদফতর আনুষ্ঠানিকভাবে এখানকার জরিপ কার্যক্রমও শুরু করে। পরে আর কিছুই জানানো হয়নি।
সরেজমিনে দেখা যায়, ২০০ বছরের পুরোনো হলেও গৌরারং জমিদার বাড়িতে রয়েছে ছয়টি আলাদা ভবন। রঙমহলের দেয়ালে রয়েছে নর-নারী ও লতাপাতার ছবি, রয়েছে অন্দরমহল, সিংহাসন ও জলসাঘর। এগুলো আজও দর্শনার্থীদের আকৃষ্ট করে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, দুই বছর আগে সুনামগঞ্জের গৌরারং জমিদার বাড়িকে প্রত্নতাত্ত্বিক জাদুঘর করার উদ্যোগ নেয়া হয়। ২০১৯ সালের ১৫ মে জেলার বিভিন্ন প্রত্নতাত্ত্বিক স্থাপনার জরিপের সূচনা করেছিলেন সিলেটের বিভাগীয় কমিশনার। এরইমধ্যে জেলার দুটি ঐতিহাসিক প্রত্নতাত্ত্বিক স্থাপনা তাহিরপুরের লাউর রাজ্যের রাজধানীর হলহলিয়া রাজবাড়ি ও পাইলগাঁওয়ের জমিদার বাড়ি সংরক্ষণ করেছে সরকার।
সচেতন নাগরিক কমিটির (সনাক) জেলা কমিটির সভাপতি অ্যাডভোকেট আইনুল ইসলাম বাবলু বলেন, ‘গৌরারং জমিদার বাড়ির পাশে তিনটি দিঘি, দুটি মন্দির, একটি প্রধান ফটক, হাতিশালা-শ্মশানঘাট ও রানীর গোসলখানা আগের মতোই রয়েছে। অন্যান্য অঞ্চলে এ ধরনের পুরাকীর্তি ধ্বংস হয়ে গেছে। কিন্তু এখানে অক্ষত অবস্থায় রয়েছে এ দৃষ্টিনন্দন স্থাপনাটি। কমপ্লেক্সের ভেতরে নেই কোনো জনবসতিও’।
তিনি আরও বলেন, ‘জমিদার বাড়িটিকে সুনামগঞ্জের প্রত্নতাত্ত্বিক জাদুঘর হিসেবে তৈরি করা যেতে পারে। এ অঞ্চলের বিভিন্ন প্রত্নবস্তু এখানে সংরক্ষণ ও প্রদর্শনের ব্যবস্থা করা গেলে ইতিহাস ও ঐতিহ্য রক্ষা পাবে’।
স্থানীয়রা জানান, সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের প্রত্নতত্ত্ব অধিদফতরের চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগের আঞ্চলিক পরিচালক ড. মো. আতাউর রহমান, কুমিল্লার শালবন বিহারের ময়নামতি জাদুঘরের কাস্টোডিয়ান ড. আহমেদ আবদুল্লাহ, ময়নামতি জাদুঘরের সহকারী কাস্টোডিয়ান মো. হাফিজুর রহমান, প্রত্নতত্ত্ব অধিদফতরের চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগীয় আঞ্চলিক পরিচালক অফিসের সিনিয়র ড্রাফটসম্যান মো. সিরাজুল ইসলামসহ অনেকে কয়েকবার সুনামগঞ্জের গৌরারং জমিদার বাড়ি পরিদর্শন করেছেন। কিন্তু দুই বছর পার হয়ে গেলেও এ বিষয়ে কোনো অগ্রগতি নেই।
প্রত্নতত্ত্ব অধিদফতরের চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগের আঞ্চলিক পরিচালক ড. মো. আতাউর রহমান বলেন, ‘গৌরারং জমিদার বাড়ি সংরক্ষণের প্রস্তাবনা প্রত্নতত্ত্ব অধিদফরে পাঠানো হয়েছে। আমরা নির্দেশনার অপেক্ষায় আছি’।
তিনি এ বিষয়ে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করবেন বলে জানান।
মৌলবীবাজার থেকে জমিদার বাড়িতে আসা দর্শনার্থী আমিরুল হক বলেন, ‘অনেক নামডাক শুনেছি এ জমিদার বাড়ির। আজ তা নিজের চোখে দেখলাম। সত্যি অসাধারণ বাড়িটি। এর সঠিক সংরক্ষণ প্রয়োজন’।
সিলেট থেকে আসা দর্শনার্থী মুনিয়া আক্তার বলেন, ‘শহর থেকে খুব কাছেই জমিদার বাড়িটি অবস্থিত। কিন্তু এতটুকু জায়গা আসতেই অনেক কষ্ট করতে হয়। আসার রাস্তা ভাঙা’।
তিনি আরও বলেন, ‘এখানে আসার রাস্তাঘাট মেরামত করে এ বাড়িটিকে পর্যটনকেন্দ্র হিসেবে তৈরি করার জন্য সরকারের কাছে আহ্বান জানাচ্ছি’।
সিলেট থেকে আসা আরেক দর্শনার্থী শাকিল তালুকদার বলেন, ‘এটি সত্যিই দুঃখজনক। ২০০ বছরের পুরোনো জমিদার বাড়িটি অযত্ন-অবহেলায় পড়ে আছে। সরকার কাছে এর সংরক্ষণের দাবি জানাই’।