মোঃ আব্দুল বাতেন বাচ্চু,
প্রতিবেদক:
জলেই জন্ম, জলেই মৃ’ত্যু, জলেই বসবাস; নাগরিক হয়েও তারা নিজ দেশে পরবাস’’ —এক স্লোগানেই বেদে সম্প্রদায়ের পরিচয় পাওয়া যায়। শত শত বছর ধরে প্রচলিত সমাজ ও সভ্যতার প্রতি এক ধরনের উদাসীনতা রয়েছে বেদে সম্প্রদায়ের।
বেঁচে থাকা ছাড়া যেনো আর কোনো চাহিদাই নেই তাদের। নদীর স্রোত কিংবা বহমান বাতাসের মতোই তাদের জীবন। দেশের অ’তিপরিচিত প্রান্তিক যাযাবর গোষ্ঠী বেদে। একসময় শুধুই জলে বসবাস করলেও …
এখন ডাঙায়ও তাদের দেখা মিলে। বই – পুস্তকে এই সম্প্রদায়কে বেদে নামে উল্লেখ করলেও , দেশজুড়ে রয়েছে অনেক নাম । বাদিয়া , বাইদ্যা বা বইদ্যানী নামে ডা’কা হয় বিভিন্ন অঞ্চলে । তাদেরকে জলের জিপসিও বলা হয়। কেউ সাপুড়ে, কেউ গ্রাম্য চিকিৎসক।
মোরা এক ঘাটেতে রাঁধি বাড়ি, মোরা আরেক ঘাটে খাই, মোদের সুখের সীমা নাই … আম’রা সাপ খেলা দেখাই।
সাপ মানুষের ভয়ের কারণ হলেও বেদেদের কাছে জীবনধারনের প্রধান অবলম্বন। সাপের খেলা দেখিয়েই রুটি – রুজি চলে তাদের। এই বিষধর প্রাণী যাদের হাতে খেলনা হয়ে ওঠে— তাদের কাছে জীবনযাপন তো খুব সাধারণ ব্যাপার। সাপখেলা দেখানোর জন্য সাপুড়েরা সাধারণত গোখরা ও অজগরই বেশি পছন্দ করে। সাপুড়েদের গোখরা পছন্দের কারণ গোখরা মা’থার ফণা খানিকটা মাটির উপরে শূন্যে তুলে মেলে ধরতে পারে, যাতে থাকে দৃষ্টিনন্দন নকশা। তবে গোখরা বাঁশির সুরে নয়, সাপুড়ের দুলতে মা’থা, হাঁটু ও কনুইয়ের দিকে দৃষ্টি স্থির করার লক্ষ্যেই দুলতে থাকে। তবে নির্বিষ সাপও রাখে তারা। সাধারণ হিসাবে বেদে সম্প্রদায়ের পরিচয় সাপ খেলা দেখানো জনগোষ্ঠী হলেও, মূলত এরা গ্রাম্য চিকিৎসক। যারা বংশ পরম্পরায় গাছ – গাছড়া থেকে চিকিৎসা পদ্ধতির দাবিদার। বেদেদের মধ্যে যারা মূলত সাপ খেলা দেখায় তারা বাঁশিসহ অন্যান্য বাদ্যযন্ত্র বাজিয়ে এবং নানা উপায়ে সাপের খেলা দেখায়। সাপ অবশ্য বায়ুবাহিত শব্দ – তরঙ্গ অনুভব করে না, ফলে এতে সাপের সাড়া দেয়ার প্রশ্ন আসে না।
এটি ঐতিহ্যগতভাবে পারিবারিক পেশা, প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে হস্তান্তরিত হয়। এতে আছে কঠোর গো’পনীয়তা। নদীর বুকে সংসার যেমন বেদে সম্প্রদায়ের সংসার, পরিবার ও সমাজ একেবারেই ভিন্ন। বেদে ছে’লেরা সাধারণত কাজ করে না। মে’য়েরা যখন রোজগারে বাইরে যায় তখন সংসার ও বাচ্চা সামলায় তারা। ছে’লেরাই পুরো ঘর গুছিয়ে পরিপাটি করে রাখে। তবে বেদেনীরা তাদের স্বামীকে ভালোবাসা দিয়ে সবসময় আগলে রাখে। স্বামীকে বশে রাখতে কখনো শরীরে মালিশ করে দেয় সাপের চর্বির তেল, কখনো আবার করে রাখে তাবিজ -কবজ।
বেদে সমাজে সাধারণত বাল্যবিবাহ, বহুবিবাহ, যৌথ পরিবারের মতো প্রথাগুলো খুব একটা দেখা যায় না। বেদেনীরা স্বাধীনচেতা। বেদে যুবক যুবতীরা স্বেচ্ছায় পরস্পরকে পছন্দ করে বিয়েতে সম্মত হয়। পারিবারিকভাবে বিয়ের আয়োজন করা হয়। বর – কনেসহ উপস্থিত সবাই নাচ – গানের মাধ্যমে উৎসবে মেতে ওঠে। …
বেদে’দের কর্মজীবন যা – ই হোক, জীবনের নানা ক্ষেত্রে এ সম্প্রদায়ের রয়েছে বৈচিত্রময় কিছু রীতি। মু’সলমান হলেও বিয়ের রীতি ডাঙ্গাবাসী থেকে একটু ভিন্ন। এক নৌকা থেকে অন্য নৌকায় পছন্দের মে’য়েটিকে তুলে নিলেই বিয়ে হয়ে যায়। এরপর হুজুর এনে কলেমা পড়ানো হয়। তবে একসময় টাকা দিয়ে মে’য়ে কেনাবেচা হতো। ৪০-৫০ হাজার থেকে শুরু করে লাখ টাকা পর্যন্ত বানে বিয়ে করতে হয় ছে’লেদের। কখনো বিচ্ছেদের ঘটনা ঘটলেও কোনো মে’য়েই ভেঙে পড়ে না। তবে মান – অ’ভিমান যে একেবারেই থাকে না তা নয়। বেদে হলেও মানুষের মন বলে কথা! বিয়ে ভেঙে দেয়ার নিয়ম বেশ সহ’জ। দাম্পত্য কলহের কারণে বিয়ে বিচ্ছেদের সিদ্ধান্ত নিলে বধূটি স্বামীর নৌকা থেকে লাফ দিয়ে বাবার নৌকায় গেলেই তালাক হয়ে যায়। তাদের বিয়ের কোনো নিবন্ধন হয় না। বিয়ের অল্প সময়ের মধ্যে বিচ্ছেদ হলে মে’য়েকে বানের টাকা (যৌতুক) ফেরত দিতে হয়। আর পুরোনো হলে সম্পত্তির অর্ধেক দিতে হবে। কারণটাও যু’ক্তিসঙ্গত। বেদে সমাজে নারী – পুরুষ উভ’য়ই সমানতা’লে খাটে উপার্জনের জন্য। অনেক ক্ষেত্রে ছে’লেদের চেয়ে মেয়েরাই গিয়ে থাকে বেশি।
আ’মেনা খাতুন নামের এক বেদেনী জানান, নদীর উচু ঢেউ বা প্রাকৃতিক দূর্যোগে শক্ত হাতে নৌকা চালাতে পারি। জলের গতির সঙ্গে সখ্যতা জন্মগত অধিকার । নদীর বুকে ভাসমান জীবন খুব ক’ষ্টের। ঝড় – তুফানেও বসে থাকার অবস্থা নেই। সভ্যতার ছোবল বড় নি’র্মম সাপের মতো সভ্যতার ছোবল বড় নি’র্মম।
বাংলাদেশের বেদে সম্প্রদায়ের মানুষ সাপের ছোবল সামলানোর কলাকৌশল রপ্ত করলেও সভ্যতার ছোবল থেকে বাঁচতে পারছে না। ফলে তারা আজ অস্তিত্ব সংকটে। শহরের পথে পথে সাপ হাতে নিয়ে বেদেনীদের ঘুরে ঘুরে টাকা তোলা আমাদের কাছে অ’ত্যাচার মনে হলেও তারা বেঁচে থাকার জন্যই সাপ খেলা দেখানো বাদ দিয়ে ভিক্ষাবৃত্তিতে নেমেছে। পিছুটানের বালাই নেই, বাধাহীন – নির্ভার জীবন। সে কারণেই সাধারণ গৃহী মানুষ সবসময় এক দুর্বার আকর্ষণ অনুভব করেছে বেদে সম্প্রদায়ের প্রতি। বেদে নারীর তীব্র টানে বিবাগী হয়েছে কত শত পুরুষ। বাংলা সাহিত্যে সেইসব কাহিনী খুব বড় স্থান দখল করে রয়েছে।
একটা সময় ছিলো, যখন সাপের গল্প নিয়ে প্রচুর সিনেমা তৈরি হয়েছে। ‘বেদের মেয়ে জোছনা’ বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের ইতিহাসে একটি অন্যতম ব্যবসা সফল ছবি।