দেশ টিভি বাংলা ডেস্ক:
পদ্মা সেতুর সুফল কতটা ভোগ করতে পারবে দক্ষিণাঞ্চলের মানুষ? ফরিদপুরের ভাঙ্গা থেকে বরিশাল হয়ে কুয়াকাটা পর্যন্ত থাকা সরু সড়ক ঘিরে এটাই এখন প্রশ্ন এ অঞ্চলের মানুষের। মাত্র ২৪ ফিট প্রশস্ত এ সড়কে এখনই লেগে থাকে যানজট। পদ্মা সেতু চালু হলে আরও যানজটের আকার ৩ থেকে ৪ গুণ ধারণ করবে। ফলে যানজটে আটকে বর্তমানের তুলনায় অনেক বেশি সময় লাগবে গন্তব্যে পৌঁছতে। আর এ কারণেই মিলবে না পদ্মা সেতুর সুফল।
অথচ বহু আগে এ সড়কটিকে ৬ লেন করার উদ্যোগ নিয়েছিল সরকার। প্রাথমিক পর্যায়ের কাজ সম্পন্ন এবং সড়ক প্রশস্তকরণে জমি অধিগ্রহণের জন্য দেওয়া হয়েছিল অর্থ বরাদ্দ। কিন্তু আজ পর্যন্ত শুরু হয়নি সেই কাজ। এমনকি পর পর ৩ বার ফেরত গেছে বরাদ্দ হওয়া টাকা। এমন অবস্থায় স্বপ্নের পদ্মা সেতু শেষ পর্যন্ত দুঃস্বপ্নে পরিণত হয় কিনা তা নিয়ে দেখা দিয়েছে শঙ্কা।
বঙ্গবন্ধু সেতু চালু হওয়ার পর উত্তরবঙ্গের সঙ্গে রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশের সড়ক পথে যোগাযোগ সহজ হবে বলে আশা করেছিল সবাই। কিন্তু অপ্রশস্ত ঢাকা-সিরাজগঞ্জ মহাসড়কে ভেস্তে যায় সেই স্বপ্ন। অসংখ্য যানবাহনের চাপে ঘণ্টার পর ঘণ্টা আটকে থাকতে হয় এ সড়কে। ফলে সেতু হয়ে যমুনা পাড়ি দিলেও সড়কের ব্যর্থতায় ফেরির চেয়েও ২-৩ গুণ বেশি সময় লাগত গন্তব্যে পৌঁছতে। বর্তমানে অবশ্য ঢাকা থেকে যমুনা সেতু পর্যন্ত মহাসড়ক ৪ লেন করার কাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে। এখন আর যাতায়াতে লাগছে না আগের মতো সময়। যমুনা সেতু চালুর শুরুর দিকে যে দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছে উত্তরাঞ্চলের মানুষকে ঠিক একই দুর্ভোগে পড়ার শঙ্কায় এখন দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের।।
সরকারী ঘোষণা অনুযায়ী আগামী জুনে যানবাহন চলাচলের জন্য খুলে দেওয়া হবে পদ্মা সেতু। স্বপ্ন থেকে বাস্তবে রূপ নেওয়া এ সেতু চালু হলে যানবাহনের যে চাপ বাড়বে তা সামাল দেওয়ার সক্ষমতা নেই অপ্রশস্ত ভাঙ্গা-বরিশাল-কুয়াকাটা মহাসড়কের। দক্ষিণের মানুষের শঙ্কার শুরু এখানেই।
ভাঙ্গা থেকে বরিশাল হয়ে সমুদ্র সৈকত কুয়াকাটা ও পায়রা বন্দর পর্যন্ত বর্তমানে থাকা সড়কের দূরত্ব প্রায় ২৩৫ কিলোমিটার। দীর্ঘ এ সড়কের পুরোটাই প্রস্তে মাত্র ২৪ ফিট। বর্তমানে এ সড়ক ধরে যাতায়াত করে ঢাকা ও বরিশাল বিভাগের ১০ জেলার যানবাহন। পদ্মা সেতু চালু হলে চাপ আরও বাড়বে সড়কে।
বরিশাল বাস মালিক গ্রুপের সাধারণ সম্পাদক কিশোর কুমার দে বলেন, মুক্তিযুদ্ধকালীন ১২ ফিট চওড়া বরিশাল-ভাঙ্গা সড়কটি গত ৫০ বছরে মাত্র ২৪ ফিট চওড়া হয়েছে। অথচ এই ৫০ বছরে দেশের জনসংখ্যা যেমন ৭ কোটি থেকে হয়েছে ১৮ কোটি তেমনি যানবাহনের সংখ্যাও বেড়েছে কয়েক হাজার। বর্তমানে থাকা সড়কে চলাচল করতেই হিমশিম খাচ্ছে যানবাহন। ভাঙ্গা পর্যন্ত চলতে হয় ধীর গতিতে। সেখানে পদ্মা সেতু চালু হলে ভয়াবহ হবে পরিস্থিতি। যানবাহনের চাপে চলা যাবে না সড়কে। এখন ভাঙ্গা যেতে লাগে দু’ আড়াই ঘণ্টা তখন ৩-৪ ঘন্টায়ও পৌঁছানো যাবে না। তাছাড়া অপ্রশস্ত এই সড়কে বাড়বে দুর্ঘটনার সংখ্যা।
পদ্মা সেতু চালু হলে এমন সমস্যায় যে পড়তে হবে, সে ব্যাপারে অবশ্য বহু আগেই ভেবেছে সরকার। যে কারণে ২০১৬ সালে ভাঙ্গা-বরিশাল-কুয়াকাটা মহাসড়ক ৪ লেন করার প্রাথমিক কাজ শুরু করে সড়ক ও সেতু বিভাগ। ২০১৮ সালে প্রকল্প প্রস্তাব চূড়ান্ত করার পর অনুমোদনের জন্য তা তোলা হয় জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের (একনেক) সভায়। ওই বছরের ১১ অক্টোবর পাশ হওয়া ওই প্রকল্পে ভাঙ্গা থেকে বরিশাল হয়ে কুয়াকাটা পর্যন্ত ১৯৫ কিলোমিটার দীর্ঘ ৬ লেন বিশিষ্ট এক্সপ্রেস সড়ক নির্মাণের অনুমোদন দেয় সরকার।
সড়ক নির্মাণে প্রয়োজনীয় জমি অধিগ্রহণের জন্য বরাদ্ধ দেওয়া হয় ১ হাজার ৮৬৭ কোটি ৮৫ লাখ ৯০ হাজার টাকা। প্রকল্প অনুযায়ী বিপরীতমুখী ডাবল লেনের দুটি সড়কসহ ধীর গতির স্থানীয় যানবাহন চলাচলের জন্য আলাদা দুটি সার্ভিস লেন করার অনুমোদন দেয় একনেক। সড়কটি হবে ১৭০ ফিট চওড়া। মিডল থেকে উভয় পাশে যাবে ৮৫ ফিট করে। সড়কের টপ উইথ হবে ১১ ফিট। ১১ অক্টোবর পাশ হওয়া ওই প্রকল্প প্রস্তাবে ২০২০ সালের জুন মাসের মধ্যে শেষ করতে বলা হয় জমি অধিগ্রহণের কাজ। কিন্তু ২০২০ তো দূরের কথা, ২০২২ এর মার্চে এসেও সেই কাজ শুরু করতে পারেনি সড়ক ও সেতু বিভাগ।
এখন পর্যন্ত হয়নি প্রস্তাবিত এই মহাসড়কের এক ইঞ্চি জমি অধিগ্রহণ। ইতোমধ্যে পরপর ৩ বার ফেরত গেছে এই প্রকল্পের জন্য বরাদ্দ হওয়া অর্থ। সর্বশেষ চলতি অর্থবছরে যে টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে তাও রয়েছে ফেরত যাওয়ার ঝুঁকিতে।
বিষয়টি নিয়ে আলাপকালে সড়ক ও সেতু বিভাগের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মাসুদ খান বলেন, সড়ক নির্মাণে ঠিক কতটুকু জমি অধিগ্রহণ করতে হবে তা চিহ্নিত করার দায়িত্ব পাওয়া পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের ভুলের কারণে এই দীর্ঘসূত্রিতা। জমি চিহ্নিত করার ক্ষেত্রে একদিকে যেমন তারা সর্বশেষ ম্যাপ পর্চা ব্যবহার করেনি, তেমনি অধিগ্রহণ প্রস্তাবনার জমি চিহ্নিতকরণে ছিল ত্রুটি। ১৯৫ কিলোমিটার দীর্ঘ সড়ক প্রশস্তকরণে তারা প্রস্তাব করেছে মাত্র ৩০২ একর জমি অধিগ্রহণের। বিষয়টি নিয়ে খটকা লাগায় পরে আমরা নিজস্ব সার্ভেয়ার দিয়ে যখন জরিপ করি, তখন দেখা যায় জমি লাগবে ১ হাজার ৯১ একর। এভাবে নানা ভুলের কারণে নির্ধারিত সময়ে শুরু করা যায়নি অধিগ্রহণ।
প্রকল্পের পরিচালক সড়ক ও সেতু বিভাগের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী তারেক ইকবাল বলেন, শুরুর দিকে যাইহোক বর্তমানে অত্যন্ত দ্রুত গতিতে চলছে জমি অধিগ্রহণের কাজ। সড়ক নির্মাণের জন্য প্রয়োজনীয় জমি চিহ্নিত করার পর তা অধিগ্রহণের ব্যবস্থা নিতে চিঠি পাঠানো হয়েছে ফরিদপুর, গোপালগঞ্জ, মাদারীপুর এবং বরিশালের জেলা প্রশাসনকে। পটুয়াখালীতে জমি চিহ্নিতকরণ প্রশ্নে কিছু জটিলতা দেখা দেওয়ায় অবশ্য সেখানকার জেলা প্রশাসনকে এখনো কোনো চিঠি দেইনি আমরা। সবকিছু ঠিক থাকলে চলতি বছরের শেষ নাগাদ সড়ক নির্মাণ কাজ শুরু হবে বলে আশা করছি।