ট্রিপল মার্ডারের রহস্য ফাঁস
মানিকগঞ্জ প্রতিনিধি:
মানিকগঞ্জের ঘিওরে আলোচিত স্ত্রী ও দুই মেয়েকে গলাকেটে করে হত্যার ঘটনায় এলাকায় শোক আর আতঙ্ক বিরাজ করছে।
স্ত্রী ও দুই মেয়ে হত্যার ঘটনার পর থেকে রুবেলের গ্রামের মানুষ, আত্মীয়স্বজন থেকে শুরু করে দন্ত্যচিকিৎসার চেম্বার বানিয়াজুরী বাসস্ট্যান্ড এলাকার ব্যবসায়ী ও সাধারণ মানুষের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে।
গত রোববারের এই নৃশংস ঘটনার নেপথ্য রহস্য নিয়ে পুলিশ প্রশাসন, স্থানীয় বাসিন্দা এবং স্বজনদের মধ্যে ব্যাপক আলোচনা চলছে।
পুলিশের প্রাথমিক তদন্ত ও স্থানীয় সুত্র মারফৎ জানা গেছে, সম্প্রতি ভুল চিকিৎসায় দেড় লাখ টাকা অর্থদণ্ডসহ দেনায় জর্জরিত হয়ে পড়েন একইসাথে পরিবার থেকেও বিতাড়িত হয়ে মানসিকভাবে বিকারগ্রস্ত হয়ে পড়েছিলেন অভিযুক্ত আসাদুর রহমান রুবেল।
প্রায় ২২ বছর আগে রুবেল ভালোবেসে একই গ্রামের লাভলী আক্তারকে বিয়ে করেন। এ বিয়ে মেনে নেয়নি রুবেলের পরিবার। দন্ত্যচিকিৎসক হিসেবে বানিয়াজুরী বাসস্ট্যান্ডে কাজ করতে থাকেন তিনি। বাড়িতে বাবা-মা ও ভাইদের সঙ্গে বনিবনা না হওয়ায় শ্বশুরবাড়িতে স্ত্রী-সন্তান নিয়ে ওঠেন। এরই মধ্যে একাধিক ব্যবসার চেষ্টা করে ধার দেনায় জর্জরিত হয়ে পড়েন রুবেল। পাশাপাশি চিকিৎসা পেশাও ভালো কিছু করতে পারছিলেন না। এ নিয়ে হতাশায় ভুগছিলেন।
এলাকাবাসী জানান, সংসারে অভাবের কারণে স্ত্রীর সঙ্গে প্রায়ই ঝগড়া হতো। রুবেলের বড় মেয়ে ছোঁয়া (১৬) এসএসসি পরীক্ষার্থী আর ছোট মেয়ে কথা (১২) ৫ম শ্রেণিতে পড়ত।
হত্যাকাণ্ডের দিন দুপুরে রুবেল আটকের পর এডিশনাল এসপি হাফিজুর রহমান ও ঘিওর থানার ওসিকে দেয়া রুবেলের জবানবন্দিতে বেরিয়ে আসে চাঞ্চল্যকর বেশ কিছু তথ্য ।
রুবেলের জবানবন্দীর বরাতে এডিশনাল এসপি হাফিজুর রহমান জানান, সম্প্রতি রুবেল কতৃক এক নারী ভুল চিকিৎসার শিকার হন। রোগীর ভগ্নিপতি বেলায়েত হোসেন, স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা আবুল কালাম আজাদ, শুভ, একজন প্রশাসনিক কর্মকর্তাসহ কয়েকজন প্রভাবশালী এ নিয়ে সালিস বসে। এর আগে রুবেলের সহযোগীর মোটরসাইকেল আটক করে ২০ হাজার টাকা জরিমানা নেয় তারা। এরপর ঘরোয়া সালিসে রুবেলকে দেড় লাখ টাকা জরিমানা করা হয়। ব্যবসা গুটিয়ে নেওয়ারও জন্য হুমকি দেওয়া হয়।
পারিবারের সূত্রে জানা যায়, ওই ঘটনার পর থেকে রুবেল মানসিকভাবে আরও হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়েন। গত রোববার ঘটনার দিন জরিমানার টাকা পরিশোধ করার কথা ছিল তার ।
রুবেলের পরিবার ও এলাকাবাসি সুত্রে জানা গেছে, জরিমানার ওই ঘটনার সঙ্গে যারা জড়িত, তারা এখন ঘটনা ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করছেন। গোয়েন্দা সংস্থার লোকজনও জরিমানার বিষয়টি উদঘাটনের চেষ্টা করছেন।
সালিসের মূল হোতা বেলায়েত হোসেন। তাঁর বাড়ি ঘিওরের দোতরা এলাকায় হলেও থাকেন শ্বশুরবাড়ি অর্থাৎ বানিয়াজুরী বাসস্ট্যান্ড এলাকার, মরাথুরা গ্রামে। ক্ষমতাসীন দলের কিছু প্রভাবশালীর ছত্রছায়ায় নানা অপকর্ম করে আসছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
রুবেলের স্ত্রী লাভলী আক্তারের মা হালিমা বেগম বলেন, ‘জরিমানার টাকা এবং যাদের কাছ থেকে ধারদেনা করেছে তাদের চাপের কারণেই আমার মেয়ে ও দুই নাতিনকে রুবেল হত্যা করেছে। হত্যার বিচারের সঙ্গে যারা জরিমানা করেছে তাদেরও সবার বিচার চাই।’
লাভলী আক্তারের বাবা সাইজ উদ্দিন বলেন, ‘রুবেলের শাস্তির পাশাপাশি তার মা-বাবারও শাস্তি চাই। কেন রুবেলকে বাড়ি থেকে বিতাড়িত করে দিয়েছে, কেন ওর দেনা-পাওয়া তারা পরিশোধ করল না।’
উল্লেখ্য, গত রোববার ভোর রাতে স্ত্রী ও দুই মেয়েকে মাথায় আঘাত করে অচেতন করে মুখে বালিশ চাপা দিয়ে হত্যা নিশ্চিত করে ধারালো অস্ত্র (দা) দিয়ে গলা কাটেন। এরপর তিনি পাঁচুরিয়া এলাকায় মহাসড়কের ওপর আত্মহত্যার জন্য শুয়ে পড়েন। সেখান থেকে পুলিশ তাঁকে গ্রেপ্তার করে।
ঘিওর থানার ওসি রিয়াজ উদ্দিন আহমেদ বিপ্লব বলেন, ‘হত্যাকাণ্ডের পর ২৪ ঘণ্টার মধ্যে পুলিশ আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করেছে। হত্যাকাণ্ডের আগে পরের সব ঘটনা তদন্ত করা হচ্ছে। ঘটনার সঙ্গে যে বা যারা জড়িত রয়েছে তাদের সবাইকে আইনের আওতায় আনা হবে।